""""""""""""""""""""""""""""""""""""""'""""""""""""""""
[সুরা-নিসা, আয়াত-০১, তফসীর]
---------------------------------------------------
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম,
---------------------------------------------
মহান আল্লাহ তা'আলা বলেন-
---
"হে মানুষ !
তোমরা তোমাদের 'রবে'র তাকওয়া (আল্লাহ ভীতি) অবলম্বন কর, [১]
যিঁনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন,
ও তার থেকে তার স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন [২] এবং
তাদের দুজন থেকে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দেন, আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর,
যাঁর নামে তোমরা একে অপরের কাছে নিজ নিজ হক দাবী করে থাক। [৩]
এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারেও। [৪]
নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখেন।" [৫]
___________[সুরা-নিসা, আয়াত-০১]________
~~~
০১ নং আয়াতের তফসীর-
[১] সূরার শুরুতে,
পারস্পরিক সম্পর্ক এবং অন্যের অধিকার সংক্রান্ত বিধান জারি করা হয়েছে।
যেমন-
অনাথ ইয়াতীমের অধিকার, আত্মীয়-স্বজনের অধিকার,
ও স্ত্রীদের অধিকার প্রভৃতির কথা বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে,
'হক্কুল-‘ইবাদ' বা অন্যের অধিকারের সাথে সংশ্লিষ্ট,
এমন কতকগুলো অধিকার রয়েছে, যেগুলো সাধারণতঃ
দেশের প্রচলিত আইনের আওতায় পড়ে এবং আইন প্রয়োগের মাধ্যমে তা কার্যকর করা যেতে পারে।
সাধারণ ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্রয়-বিক্রয়, ভাড়া ও শ্রমের মজুরী প্রভৃতি এ জাতীয় অধিকার যা মূলতঃ
দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ভিত্তিতে কার্যকর হয়ে থাকে।
এসব অধিকার যদি কোন এক পক্ষ আদায় করতে ব্যর্থ হয়, অথবা
সেক্ষেত্রে কোন প্রকার ক্রটি-বিচ্যুতি হয়,
তাহলে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে তার সুরাহা করা যেতে পারে।
---
কিন্তু সন্তান-সন্ততি, পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, কারো নিজ বংশের, ইয়াতীম ছেলে-মেয়ে
এবং আত্মীয়-স্বজনের পারস্পারিক অধিকার আদায় হওয়া নির্ভর করে
সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও আন্তরিকতার উপর।
এসব অধিকার তুলাদণ্ডে পরিমাপ করা যায় না। কোন চুক্তির মাধ্যমেও তা নির্ধারণ করা দুষ্কর।
সুতরাং এসব অধিকার আদায়ের জন্য আল্লাহ-ভীতি,
এবং আখেরাতের ভয় ছাড়া দ্বিতীয় আর কোন উত্তম উপায় নেই।
আর একেই বলা হয়েছে ‘তাকওয়া’।
বস্তুতঃ এই তাকওয়া,
দেশের প্রচলিত আইন ও প্রশাসনিক শক্তির চেয়ে অনেক বড়।
তাই আলোচ্য সূরাটিও তাকওয়ার বিধান দিয়ে শুরু হয়েছে।
সম্ভবতঃ
এ কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম,
বিয়ের খোত্বায় এ আয়াতটি পাঠ করতেন।
বিয়ের খোতবায় এ আয়াতটি পাঠ করা সুন্নাত।
তাকওয়ার হুকুমের সাথে সাথে,
আল্লাহর অসংখ্য নামের মধ্যে এখানে ‘রব’ শব্দটি ব্যবহার করার মধ্যেও, একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে।
অর্থাৎ এমন এক সত্তার বিরুদ্ধাচারণ করা কি করে সম্ভব হতে পারে,
যিঁনি সমগ্র সৃষ্টিলোকের লালন-পালনের যিম্মাদার,
এবং যাঁর রুবুবিয়্যাত বা পালন-নীতির দৃষ্টান্ত সৃষ্টির প্রতিটি স্তরে স্তরে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত।
~~~
[২] এখানে দু’টি মত রয়েছে,
(এক) তার থেকে অর্থাৎ তারই সমপর্যায়ের করে তার স্ত্রীকে সৃষ্টি করেছেন।
(দুই) তার শরীর থেকেই তার স্ত্রীকে সৃষ্টি করেছেন।
এ মতের সপক্ষে হাদীসের কিছু উক্তি পাওয়া যায়, যাতে বুঝা যায় যে,
মহিলাদেরকে বাকা হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
[দেখুন- বুখারীঃ ৩৩৩১, মুসলিমঃ ১৪৬৮]
~~~
[৩] বলা হয়েছে যে,
যাঁর নাম উচ্চারণ করে তোমরা অন্যের থেকে অধিকার দাবী কর,
এবং যাঁর নামে শপথ করে অন্যের কাছ থেকে
নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করে থাক সে মহান সত্ত্বার তাকওয়া অবলম্বন কর।
আরও বলা হয়েছে যে,
আত্মীয়তার সম্পর্কে -তা পিতার দিক থেকেই হোক,
অথবা মায়ের দিক থেকেই হোক -তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাক,
এবং তা আদায়ের যথাযথ ব্যবস্থা অবলম্বন কর।
~~~
[৪] আলোচ্য আয়াতের দু'টি অর্থ হতে পারে।
একটি যা ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে, অর্থাৎ তোমরা,
আত্মীয়তার সম্পর্কের ব্যাপারে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর। সুতরাং তোমরা আত্মীয়তার সম্পর্ক ঠিক রাখ।
এ অর্থটি ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত আছে। [তাবারী]
আয়াতের দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে,
তোমরা যে আল্লাহ ও আত্মীয়তার সম্পর্কের খাতিরে পরস্পর কোন কিছু চেয়ে থাক।
অর্থাৎ তোমরা সাধারণত বলে থাক যে, আমি আল্লাহর ওয়াস্তে,
এবং আত্মীয়তার সম্পর্কের খাতিরে কোন কিছু তোমার কাছে চাই।
সুতরাং দু’ কারণেই তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর। এ অর্থটি মুজাহিদ থেকে বর্ণিত হয়েছে।
[আত-তাফসীরুস সহীহ]
---
পবিত্র কুরআনে,
আত্মীয়তার সম্পর্ক বুঝানোর জন্য ‘আরহাম’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, যা মূলতঃ
একটি বহুবচনবোধক শব্দ।
এর একবচন হচ্ছে ‘রাহেম’। যার অর্থ জরায়ু বা গর্ভাশয়।
অর্থাৎ জন্মের প্রাক্কালে মায়ের উদরে যে স্থানে সন্তান অবস্থান করে।
জন্মসূত্রেই মূলতঃ
মানুষ পারস্পরিক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হয়।
আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের বুনিয়াদকে ইসলামী পরিভাষায় ‘সেলায়ে-রাহ্মী’ বলা হয়।
আর এতে কোন রকম বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হলে তাকে বলা হয়
‘কেত্বয়ে-রাহ্মী’।
---
হাদীসে আত্মীয়তার সম্পর্কের উপর বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
"যে ব্যক্তি তার রিযিকের প্রাচুর্য এবং দীর্ঘ জীবনের প্রত্যাশা করে,
তার উচিত আত্মীয়-স্বজনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা।"
[বুখারীঃ ২০৬৭; মুসলিমঃ ২৫৫৭]
---
অন্য হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেনঃ
‘রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের প্রায় সাথে সাথেই,
আমিও তার দরবারে গিয়ে হাজির হলাম। সর্বপ্রথম আমার কানে তার যে কথাটি প্রবেশ করল,
তা হল এইঃ
"হে লোক সকল!
তোমরা পরস্পর পরস্পরকে বেশী বেশী সালাম দাও।
আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য মানুষকে খাদ্য দান কর।
আত্মীয়-স্বজনের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোল এবং,
রাতের বেলায় সালাতে মনোনিবেশ কর, যখন
সাধারণ লোকেরা নিদ্রামগ্ন থাকে।
স্মরণ রেখো,
এ কথাগুলো পালন করলে তোমরা পরম সুখ ও শান্তিতে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে'’।
[মুসনাদে আহমাদ: ৫৪৫১; ইবন মাজাহ ৩২৫১]
---
অন্য হাদীসে এসেছে,
‘উম্মুল-মুমিনীন,
মায়মুনা রাদিয়াল্লাহু আনহা তাঁর এক বাঁদিকে মুক্ত করে দিলেন।
অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট যখন এ খবর পৌঁছালেন,
তখন তিঁনি বললেন,
তুমি যদি বাঁদিটি তোমার মামাকে দিয়ে দিতে,
তাহলে অধিক পূণ্য লাভ করতে পারতে।
[বুখারীঃ ২৫৯৪]
---
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আরও বলেছেনঃ
‘কোন অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিকে সাহায্য করলে সদকার সওয়াব পাওয়া যায়।
কিন্তু কোন নিকট আত্মীয়কে সাহায্য করলে,
একই সঙ্গে সদ্কা এবং আত্মীয়তার হক আদায়ের দ্বৈত পূণ্য লাভ করা যায়’।
[বুখারীঃ ১৪৬৬, মুসলিমঃ ১০০০]
~~~
[৫] এখানে মানুষের অন্তরকে আত্মীয়-স্বজনের,
অধিকার আদায়ের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে আল্লাহ বলেন,
‘আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে খুবই সচেতন ও পর্যবেক্ষণকারী।’
আল্লাহ তোমাদের অন্তরের ইচ্ছার কথাও ভালভাবে অবগত রয়েছেন।
কিন্তু যদি লোক লজ্জার ভয়ে,
অথবা সমাজ ও পরিবেশের চাপে পড়ে আত্মীয়-স্বজনের প্রতি,
সুব্যবহার করা হয়ে থাকে তাহলে আল্লাহর কাছে এর কোন মূল্য নেই।
________[তফসীর আবু বকর যাকারিয়া]______
0 Comments