Ad

প্রশ্ন: মৃতদের জন্য কখন (একাকী) হাত তুলে দু'আ করা যায়? মৃতকে দাফন শেষে নাকি পরবর্তীতে কবর যিয়ারত করতে গিয়ে হাত তুলে দুআ করা যায়। এই বিষয়ে শারঈ হুকুম কী? দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব

 

Islamic post
Islamic post


প্রশ্ন: মৃতদের জন্য কখন (একাকী) হাত তুলে দু'আ করা যায়? মৃতকে দাফন শেষে নাকি পরবর্তীতে কবর যিয়ারত করতে গিয়ে হাত তুলে দুআ করা যায়। এই বিষয়ে শারঈ হুকুম কী? দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব। সম্পাদনায়: ওস্তাদ আব্দুল্লাহীল হাদী বিন আব্দুল জলিল আল মাদানী (হাফিজাহুল্লাহ)।

☘▬▬▬▬▬▬▬▬●◈●▬▬▬▬▬▬▬▬☘
ভূমিকা: আমারা গত পর্বে মৃতের জন্য দু'আ করা এবং হাত তুলে দু'আ করার সাধারণ মূলনীতি আলোচনা করেছি। যারা সেই পর্বটি এখনো পড়েননি আপনারা কমেন্ট থেকে সেটি পড়ে নিন; তাহলে পুরো বিষয়টি পরিস্কার ভাবে বুঝতে সহজ হবে ইনশাআল্লাহ। আজ আমরা মৃতকে দাফনের পর তার জন্য একাকী ক্ষমা প্রার্থনা করা ও তার দৃঢ় থাকার জন্য দু‘আ করা এবং পরবর্তীতে কবর যিয়ারত করতে গিয়ে তার জন্য হাত তুলে দু'আ করা জায়েজ কিনা সেটি পরিস্কার করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
.
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! মৃত ব্যক্তিকে দাফন করার পর কিংবা পরবর্তীতে কবর যিয়ারত করতে গিয়ে তার জন্য দু'আ এবং ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়ে প্রসিদ্ধ দুটি হাদীস রয়েছে। আর সেই হাদীসগুলোর আলোকে মৃত ব্যক্তির জন্য একাকী হাত তুলে দু'আ করা অথবা হাত তোলা ছাড়া দু'আ করা অর্থাৎ উভয় অবস্থাতেই দু'আ করা জায়েজ মর্মে বহু প্রসিদ্ধ সালাফ থেকে প্রমাণ রয়েছে।
.
এ ব্যাপারে প্রথমে নাবাউয়ী সুন্নাহ’য় বর্ণিত প্রসিদ্ধ দুটি হাদীস এবং সালাফদের ফাতওয়া নিম্নে উল্লিখিত হলো:
.
◈ (১).প্রখ্যাত সাহাবী উসমান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) [মৃত: ৩৫ হি.] সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃতের দাফন শেষ করে সেখানে দাঁড়িয়ে বলতেন, اسْتَغْفِرُوا لِأَخِيكُمْ، وَسَلُوا لَهُ بِالتَّثْبِيتِ، فَإِنَّهُ الْآنَ يُسْأَلُ "তোমাদের ভাইয়ের জন্য তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং সে যেন প্রতিষ্ঠিত থাকে সেজন্য দু‘আ করো। কেননা তাকে এখনই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।" (আবু দাঊদ হা/৩২২১; মিশকাত হা/১৩৩; হাদীসটি বিশুদ্ধ)
.
এই হাদীসের আলোকে মৃতকে দাফনের পরে তার ‘তাসবীত’ (التثبيت) অর্থাৎ মুনকার ও নাকীর (দু’জন অপরিচিত ফেরেশতা)-এর সওয়ালের জওয়াব দানের সময় যেন তিনি দৃঢ় থাকতে পারেন, সেজন্য ব্যক্তিগত ভাবে সেখানে উপস্থিত সকলের দুআ করা সুন্নাহ। যদিও এই হাদীসে হাত তুলে দু'আ করার কথা নেই। তবে কেউ চাইলে একাকী হাত তুলতে পারবে অথবা হাত না তুলেও দু'আ করতে পারে।
.
উক্ত হাদীসের আলোকে আশ-শাইখ, আল-আল্লামাহ, আল-মুহাদ্দিস, আল-মুফাসসির, আল-ফাক্বীহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন আলী আশ-শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১২৫০ হি.] বলেছেন, "فيه مشروعية الاستغفار للميت عند الفراغ من دفنه ، وسؤال التثبيت له ؛ لأنه يسأل في تلك الحال". "দাফন শেষে মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করা এবং সে যেন প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে এজন্য প্রার্থনা করা শরীয়ত সম্মত। কেননা সেই সময় তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়।" (নায়লুল আওত্বার, খন্ড: ৪, পৃষ্ঠা:১১০)
.
ইমাম ইবনুল মুনযির (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন; قال بمشروعيته ـ الدعاء ـ الجمهور ، وقال الآجري وغيره : يستحب الوقوف بعد الدفن قليلاً ، والدعاء للميت .."জামহুর বলেন যে, দুআ শরিয়ত সম্মত। আর আজুরী (রহিমাহুল্লাহ) ও অন্যন্য ব্যক্তিবর্গ বলেছেন, দাফন করার পর অল্প সময় অবস্থান করা এবং তার জন্য দু'আ করা মুস্তাহাব।"
.
আল-মাওসুআতুল ফিক্বহিয়্যাহ গ্রন্থে এসেছে; الاستغفارعبادة قوليه يصح فعلها للميت ... وعقب الدفن يندب أن يقف جماعة يستغفرون للميت لأنه حينئذ في سؤال منكر ونكير ... وصرح بذلك جمهور الفقهاء "ইস্তেগফার হলো একটি মৌখিক ইবাদত। মৃত ব্যক্তির জন্য তা করা বিশুদ্ধ।দাফন করার পর পরই মৃত ব্যক্তির জন্য জামাআতবদ্ধভাবে ইস্তেগফার বা দোয়া করার জন্য সেখানে অবস্থান করা মুস্তাহাব বা মানদুব। কারণ সে সময়ে মুনকার ও নাকীর তাকে প্রশ্ন করেন। এভাবেই জামরুল ফুক্বাহাগণ ব্যাখ্যা করেছেন।" (আল-মাওসুআতুল ফিক্বহিয়্যাহ,খন্ড:৪ পৃষ্ঠা:৪১)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, "الدعاء للميت بعد الدفن بالثبات والمغفرة سنة". মৃত ব্যক্তিকে দাফন করার পর তার জন্য দোয়া করা এবং মাগফিরত করা সুন্নাত। (মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড: ১৩; পৃষ্ঠা: ২০৫)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন, الوقوف بعد الدفن عند القبر والدعاء له هذا من السنة , لأن النبي صلى الله عليه وسلم كان إذا فرغ من دفن الميت وقف عليه وقال : استغفروا لأخيكم واسألوا له التثبيت فإنه الآن يسأل "মৃত ব্যক্তিকে দাফন করার পর কবরের নিকট অবস্থান করা এবং তার জন্য দু'আ করা সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। কারণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম যখন দাফন শেষ করতেন তখন সেখানে অবস্থান করতেন এবং বলতেন: তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য ইস্তেগফার কর এবং তার স্থিরতার জন্য দোয়া কর।"(উসাইমীন, লিক্বাউল বাব আল-মাফতূহ, লিক্বা নং-১১৮)।
.
অপর ফাতওয়ায় ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন; وأما الدعاء له بعد الدفن فقد ثبت عن النبي عليه الصلاة والسلام فيما رواه أبو داود : أنه كان إذا فرغ من دفن الميت وقف عليه وقال: ( استغفروا لأخيكم واسألوا له التثبيت فإنه الآن يسأل ) فمن رفع يديه عند الاستغفار له فلا حرج عليه، ومن لم يرفع وقال: اللهم اغفر له، اللهم اغفر له، اللهم اغفر له، اللهم ثبته، اللهم ثبته، اللهم ثبته، وينصرف..."দাফনের পরে তার জন্য দু'আ করা নবী (ﷺ) থেকে প্রমাণিত। ইমাম আবু দাউদ (রাহিমাহুল্লাহ) বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল (ﷺ) যখন মৃতকে দাফন শেষ করতেন,তখন তিনি তার কবরের পাশে দাঁড়াতেন এবং বলতেন, তোমার ভাইয়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং তার জন্য দৃঢ়তা প্রার্থনা করো। কারণ তাকে এখনই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। যে ব্যক্তি তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার সময় হাত তুলবে, তার কোনো দোষ নেই এবং যে হাত উঠাবে না, তারও কোনো দোষ নেই। হাত না উঠিয়ে যদি বলে- হে আল্লাহ! তাকে ক্ষমা করুন। হে আল্লাহ! তাকে ক্ষমা করুন। হে আল্লাহ! তাকে ক্ষমা করুন। হে আল্লাহ! তাকে প্রতিষ্ঠিত রাখুন। হে আল্লাহ! তাকে স্থির রাখুন। হে আল্লাহ! তাকে স্থির রাখুন। এভাবে বলে যদি চলে আসে তাতেও কোনো দোষ নেই।" (উসাইমীন, লিক্বাউল বাব আল-মাফতূহ, লিক্বা নং-৮২)।
.
বর্তমান যুগের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আশ-শাইখুল আল্লামাহ ইমাম আব্দুল মুহসিন আল-আব্বাদ আল-বাদর (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৩ হি./১৯৩৪ খ্রি.] কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো, দাফনের পর মৃতের জন্য দু'হাত তুলে ধরার হুকুম কি? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন; الأمر في ذلك واسع، فما نعلم شيئاً يدل على إثباته ولا على نفيه، فللإنسان أن يرفع وله ألا يرفع ورفع الأيدي له ثلاث حالات: 1.ـ حالات جاء النص على الرفع فيها، كالدعاء بعرفة، والدعاء عند الجمرة الأولى والجمرة الثانية، والاستسقاء. 2ـ وحالات لم يرد الرفع فيها، كالدعاء في خطبة الجمعة، فلا يرفع الإنسان يديه في الدعاء في. خطبة الجمعة، لا الخطيب ولا المأمومون؛ لأن الرسول صلى الله عليه وسلم لم يكن يرفع يديه على كثرة خطبه بالناس…وأما المواضع الأخرى التي هي مطلقة ، فالأمر فيها واسع، فله أن يرفع، وله ألا يرفع
"বিষয়টির মধ্যে প্রশস্ততা রয়েছে। এটিকে জায়েজ কিংবা নিষিদ্ধ বলার এমন কোন এমন কোন দলিল আছে বলে আমরা জানিনা। তাই কোন ব্যক্তি ইচ্ছা করলে হাত উঠাতে পারে, ইচ্ছা করলে নাও উঠাতে পারে। হাত তোলা বা না তোলার বিষয়টির কয়েকটি রূপ হতে পারে-
.
(ক) যে অবস্থায় হাত তুলে দোয়া করা মর্মে নস বা দলিল রয়েছে। যেমন: আরাফার ময়দানে দু'আ, প্রথম জামারাতে, দ্বিতীয় জামারাতে দু'আ এবং বৃষ্টির জন্য সালাতুল ইস্তিসকায় দু'আ।
.
(খ)যে অবস্থায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাত তুলেননি। যেমন: জুমআর খুতবায় হাত তুলে দু'আ করা। ইমাম এবং মুক্তাদি তাদের কেউ জুমআর খুতবায় দু'আ করার সময় হাত উত্তোলন করতো না। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের কাছে এত খুতবা প্রদান করা সত্ত্বেও তিনি তাঁর খুতবার সময় হাত উত্তোলন করে দু'আ করতেন না।
.
(গ)মুতলাক স্থান। যে অবস্থায় দু'আ করার বিষয়ে প্রশস্ততা রয়েছে। কেউ চাইলে হাত উত্তোলন করে দু'আ করতে পারে আবার কেউ চাইলে হাত উত্তোলন না করেও দু'আ করতে পারে। (শারহু আবি দাউদ হা/৩২৮১; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৬১৭৩৬)।
.
সুতরাং উক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, মৃতকে দাফনের পর সেখানে দাড়িয়ে প্রত্যেক ব্যক্তি একাকী হাত তুলে কিংবা হাত তোলা ছাড়া দু'আ করতে পারে।
.
◈(২)কবর জিয়ারতে গিয়ে একাকী হাত তুলে দুআ করা জায়েজ এবং এটি রাসূল (ﷺ) সুন্নাত দ্বারা প্রমাণিত। এই মর্মে দলিল হচ্ছে, ইমাম মুসলিম তাঁর সহিহ মুসলিমে আম্মাজান আয়শা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) [মৃত: ৫৭/৫৮ হি.] থেকে বর্ননা করেছেন। তিনি বলেন, এক রাতে রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেরিয়ে গেলেন। আমি তাঁর পেছনে বারিরা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)-
কে পাঠালাম যাতে করে তিনি কোথায় যান তা দেখে। বারিরা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) বলল; তিনি বাক্বী আল-গারক্বাদ (মদিনাস্থ কবরস্থান)-এর দিকে গেলেন। فَأَطَالَ الْقِيَامَ ثُمَّ رَفَعَ يَدَيْهِ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ "তিনি (ﷺ) বাক্বীর পাদদেশে গিয়ে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকলেন। অতঃপর তিনি তিনবার হাত উঠিয়ে দু‘আ করলেন।" এরপর চলে এলেন। অতঃপর আয়শা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, বারিরা আমার কাছে ফিরে এসে এটা জানাল। যখন ভোর হলো তখন আমি তাঁকে (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে) জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ্‌! গত রাতে আপনি কোথায় গিয়েছেন? তিনি বললেন, "আমাকে বাকীতে পাঠানো হয়েছে; যাতে করে আমি তাদের জন্য দোয়া করি"। তবে দোয়া করার সময় কবরগুলোকে সামনে রাখবে না। বরং কাবাকে সামনে রাখবে। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরের দিকে ফিরে নামায পড়তে নিষেধ করেছেন। (সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: ১২; জানাজা, পরিচ্ছেদ: ৩৫; হা/২১৪৬, ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৪২৮৭)
.
এই হাদীসে রাসূল (ﷺ) নিজে সরাসরি হাত তুলে দু'আ করেছেন। হাদিসটির ব্যাখ্যায় শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন, فيه : استحباب إطالة الدعاء وتكريره ، ورفع اليدين فيه . وفيه : أن دعاء القائم أكمل من دعاء الجالس في القبور. “এ হাদীস যে সব বিষয় রয়েছে সেগুলোর মধ্যে- (১). দুআ লম্বা করা, তা বারবার করা এবং তাতে দু হাত উত্তোলন করা মুস্তাহাব। (২). আরও রয়েছে, কবরে বসে থাকা ব্যক্তির দু'আর চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির দু'আ অধিক উত্তম। (নববী,শরহে মুসলিম হা/২১৪৬; ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য:)
.
এই হাদীসের আলোকে বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো, মৃতের কবরে হাত তুলে দু'আ করা যাবে কি?
.
তিনি রাহিমাহুল্লাহ) উত্তরে বলেন, "إن رفع يديه فلا بأس؛ لما ثبت عن النبي صلى الله عليه وسلم في حديث عائشة رضي الله عنها : أنه صلى الله عليه وسلم زار القبور ورفع يديه ودعا لأهلها رواه مسلم". "যদি কেউ তার হাত তোলে, তাতে দোষের কিছু নেই। কারণ এটি নবী (ﷺ) থেকে প্রমাণিত। আয়িশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)-এর হাদীসে এসেছে; নবী (ﷺ) কবর যিয়ারত কালে হাত তুলে তাদের জন্য দু'আ কররেছেন।" (বিন বায মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড: ১৩; পৃষ্ঠা: ৩৩৭)।
..
বর্তমান পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম, সৌদি ফতোয়া বোর্ড এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.]-কে প্রশ্ন করা হয়, মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে দুআ করার সময় দু হাত উত্তোলন করা করা কি জায়েজ?
.
তিনি হাফিযাহুল্লাহ) উত্তরে বলেন, نعم , لا بأس. الأصل فى الدعاء أن ترفع فيه الأيدي إلا ما ورد أن الرسول دعا ولم يرفع يديه. “হ্যাঁ, এতে কোনও সমস্যা নেই। কেননা দুআর ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো, এতে হাত উঠানো উচিত। তবে যে সব ক্ষেত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুআ করেছেন কিন্তু হাত উঠাননি সেসব ক্ষেত্রে ব্যতিরেকে।” [ইউটিউব চ্যানেল: ডক্টর আল্লামা সালেহ আল ফাউযান। আমার ওস্তাদ থেকে নোট করা]
.
ইমাম হাতেম আল-আ‘ছম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,مَنْ مَرَّ بِفنَاء الْقُبُور وَلم يتفكر فِي نَفسه وَلم يَدْعُ لَهُم فقد خَان نَفسه وخانهم، "যে ব্যক্তি কবরস্থানের পাশ দিয়ে গেল, কিন্তু চিন্তিত হলো না এবং কবরবাসীর জন্য দো‘আ করল না সে নিজের সাথে এবং কবরবাসীদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল।"(ইবনুল খার্রাত,আল-আকিবাহ ফী যিকরিল মাওত,পৃষ্ঠা: ১৯৫)
.
সুতরাং, প্রিয় পাঠক! উক্ত দুটি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, মৃতকে দাফনের পর সেখানে দাঁড়িয়ে প্রত্যেক ব্যক্তি একাকী হাত তুলে কিংবা পরবর্তীতে কবর যিয়ারত করতে গিয়ে একাকী তার হাত তুলে অথবা হাত তোলা ছাড়া দু'আ করতে পারে।
.
▪️এখন আমাদের পাঠকদের মনে একটি প্রশ্ন আসতে পারে, মৃত ব্যক্তির জন্য দু'আ করার সময় কোন দিকে ফিরে দু'আ করা উচিত?
.
এই প্রশ্নের জবাবে বলবো- দু'আ করার সময় কোন দিকে ফিরে দু'আ করা উচিত, এই মাসালায় মতানৈক্য রয়েছে। তবে অধিক বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, কেবলামুখী হয়ে দু'আ করা। তবে কেউ যদি ভিন্ন দিকে ফিরেও দু'আ করে তাতেও কোন সমস্যা নেই।
.
হাম্বলি মাযহাবের কিতাব কাশশাফুল ক্বেনাতে এসেছে, ويستقبل الداعي القبلة لأن خير المجالس ما استقبل به القبلة দু'আকারী ব্যক্তি কেবলার দিকে মুখ করে বসবে। কেননা কেবলার দিকে মুখ করে বসাটাই সর্বোত্তম বসার পদ্ধতি। (কাশশাফুল ক্বেনা খন্ড:১;পৃষ্ঠা:৩৬৭)। একই কথা বলা হয়েছে শাফীঈ মাজহাবের গ্রন্থ তোফাতুল মুহতাজে। (খন্ড:২ ও পৃষ্ঠা;১০৫)
.
হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল আব্বাস আহমাদ বিন আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] নাকযিত তা'সীস গ্রন্থে বলেছেন, إن المسلمين مجمعون على أن القبلة التي يشرع للداعي استقبالها حين الدعاء هي القبلة التي شرع استقبالها حين الصلاة. "সকল মুসলিম একমত পোষণ করেছেন যে- যেই কেবলার দিকে মুখ করে সালাত আদায় করা হয়; সেই কেবলার দিকে মুখ করেই দোয়া করা হলো শরীয়ত সম্মত।"(ইবনে তাইমিয়া, নাকযিত তা'সীস, খন্ড:২ পৃষ্ঠা: ৪৫২)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ)-কে জিজ্ঞেসা করা হয়েছিলো: মৃতদের জন্য দোয়া করার সময় কবরের দিকে মুখ করা কি নিষেধ (হারাম)?
.
উত্তরে তিনি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন; لا ينهى عنه ؛ بل يدعى للميت سواء استقبل القبلة أو استقبل القبر ؛ لأن النبي صلى الله عليه وسلم وقف على القبر بعد الدفن ، وقال : ( استغفروا لأخيكم واسألوا له التثبيت فإنه الآن يسأل ) رواه البخاري .ولم يقل استقبلوا القبلة ، فكله جائز ، سواء استقبل القبلة أو استقبل القبر ، والصحابة رضي الله عنهم دعوا للميت وهم مجتمعون حول القبر .
"না এটা নিষেধ নয়। বরং কেবলামুখী হয়ে হোক বা কবরের দিকে মুখ করে হোক মৃতের জন্য দোয়া করা যাবে। কেননা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দাফনের পর কবরের উপর দাঁড়িয়ে বলেছেন, তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং তার জন্য দৃঢ়তা কামনা করো। এখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে। (আবু দাঊদ, হা/৩২২১)। এই হাদীসে তিনি একথা বলেননি, কিবলার দিকে মুখ করে দোয়া করো। সুতরাং দোয়াকারী কেবলামুখী হোক বা কবরের দিকে মুখ করে হোক সবই জায়েজ। সাহাবায়ে কেরামগন মৃত ব্যক্তির জন্য কবরের চারপাশে জড়ো হয়ে দোয়া করেছেন।(বিন বায মাজমাউ ফাতওয়া খন্ড: ১৩, পৃষ্ঠা: ৩৩৮)
.
জেনে রাখা ভালো যে, কবর জিয়ারত করতে গিয়ে অথবা দাফন করার পরপর মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে সম্মিলিতভাবে হাত দুআ করা শরীয়ত সম্মত নয়। বরং প্রত্যেকে নিজে নিজে দুআ করবে। এই মর্মে সৌদি আরবের ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) আলিমগণকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে উত্তরে বলা হয়-
الدعاء عبادة من العبادات، والعبادات مبنية على التوقيف، فلا يجوز لأحد أن يتعبد بما لم يشرعه الله. ولم يثبت عن النبي صلى الله عليه وسلم صلى الله عليه وسلم أنه دعا بصحابته على جنازة ما بعد الفراغ من الصلاة عليها، والثابت عنه صلى الله عليه وسلم أنه كان يقف على القبر بعد أن يسوى على صاحبه ويقول: استغفروا لأخيكم واسألوا له التثبيت، فإنه الآن يسأل- وبما تقدم يتبين أن الصواب: القول بعدم جواز الدعاء بصفة جماعية بعد الفراغ من الصلاة على الميت، وأن ذلك بدعة-
দু‘আ অন্যতম ইবাদত। আর ইবাদত 'তাওক্বীফিয়্যাহ' তথা দলীলের উপর নির্ভরশীল। অতএব,কারো জন্য শরী‘আত বহির্ভূত পন্থায় ইবাদত করা জায়েয হবে না। আর নবী করীম (ﷺ) থেকে সাব্যস্ত হয়নি যে, তিনি জানাযার সালাতের পরে সাহাবীদের নিয়ে (হাত তুলে) দু‘আ করেছেন। তাঁর থেকে যা সাব্যস্ত হয়েছে তা হলো- তাঁর সাথীদের কবর সমান করা হলে তিনি কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বলতেন, ‘তোমাদের ভাইয়ের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং তাকে স্থির বা দৃঢ় রাখার জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ করো। কারণ এখনই তাকে প্রশ্ন করা হবে।’ পূর্বের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, মাইয়েতের জন্য সালাত আদায় করার পর দলবদ্ধভাবে মুনাজাত করা জায়েয না হওয়াই সঠিক। কারণ তা বিদ‘আত।’ (ফাতাওয়া লাজনাহ দায়েমাহ, খন্ড: ৯, পৃষ্ঠা: ১৬, ফাতওয়া নং-২২৫১)
.
সৌদি আরবের প্রথম গ্র্যান্ড মুফতি, ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইব্রাহীম আলুশ শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৩৮৯ হি.]-কে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, من السنة أن يقف المشيعون عند القبر بعد الدفن ويدعوا للمية فرادى بالرحمة والمغفرة والةثبية أما الدعاء الجماعى والةأمين على دعاء واحد من الحضور فهذا ليس من السنة "সুন্নাত হলো- মৃতকে দাফনের পর শোকার্তরা কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ব্যক্তিগতভাবে মাইয়েতের জন্য রহমত, মাগফিরাত ও তার দৃঢ় থাকার জন্য দু'আ করবে। কিন্তু দলবদ্ধ দু'আ এবং একজনের দু‘আয় উপস্থিত লোকদের আমীন আমীন বলা- এটি কোন সুন্নাতী আমল নয়। (আদ-দাওয়াত ফাতওয়া নং-১৫৭৬)। একই কথা
ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন।
.
▪️আরো একটি মাসালা জেনে রাখা ভাল আর তা হচ্ছে,অমুসলিমদের কবর (যিয়ারত) বা দেখতে যাওয়া যাবে কি? এতে কোন পাপ আছে কি?
.
জবাবে বলবো,অমুসলিম কাফির-মুশরিক পিতা-মাতা বা অন্য কোন আত্মীয়ের কবর যিয়ারত করা যাবে। তাদের জন্য ক্রন্দন করাও যাবে। কেননা এর মাধ্যমে মৃত্যুকে স্মরণ করা হয়। কিন্তু সেখানে গিয়ে তাদের উদেশ্যে সালাম করা যাবে না। তাদের জন্য আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করা যাবে না। রাসূল (ﷺ)-কে তাঁর মায়ের কবর যিয়ারতের জন্য অতটুকুই মাত্র অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। দু'আ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি যেমন,আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃতিনি বলেন, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একবার নিজের মায়ের ক্ববরে গেলেন। সেখানে তিনি নিজেও কাঁদলেন এবং তাঁর আশপাশের লোকদেরকেও কাঁদালেন। তারপর বললেন, আমি আমার মায়ের জন্য মাগফিরাত কামনা করতে আল্লাহর কাছে অনুমতি চাইলাম। কিন্তু আমাকে অনুমতি দেওয়া হলো না। তারপর আমি আমার মায়ের ক্ববরের কাছে যাওয়ার অনুমতি চাইলাম। আমাকে অনুমতি দেয়া হলো। তাই তোমরা ক্ববরের কাছে যাবে। কারণ ক্ববর মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দেয়। (সহীহ মুসলিম ৯৭৬, আবূ দাঊদ ৩২৩৪, নাসায়ী ২০৩৪, ইবনু মাজাহ্ ১৫৭২, মুসতাদরাক লিল হাকিম ১৩৯০, সহীহ আত্ তারগীব ৩৫৪২,মিশকাত হা/১৭৬৩)
.
বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, সৌদি ফাতাওয়া বোর্ডের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী, শাইখুল ইসলাম,ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] কে প্রশ্ন করা হয় কাফেরদের কবর যিয়ারত করা কি জায়েজ?
.
উত্তরে (রাহিমাহুল্লাহ) তিনি বলেন,
, إذا كان ذلك للعبرة فلا بأس به؛ لأن النبي ﷺ قد زار قبر أمه واستأذن ربه أن يستغفر لها فلم يؤذن له، وإنما أذن له بالزيارة [مجموع فتاوى ومقالات الشيخ ابن باز 13/ 337]
"শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্য হলে এতে কোন সমস্যা নেই। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মায়ের কবর জিয়ারত করেছেন। তিনি তাঁর রবের কাছে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার অনুমতি চাইলে অনুমতি দেন নি। তবে কেবল কবর জিয়ারত করার অনুমতি দেয়া হয়েছে।"( বিন বায,মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড: ১৩; পৃষ্ঠা:৩৩৭)
.
পরিশেষে, উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, মৃত ব্যক্তিকে দাফনের পর এবং পরবর্তীতপ কবর জিয়ারত করতে গিয়ে প্রত্যেক ব্যক্তি একাকী হাত তুলে কিংবা হাত তোলা ছাড়া দু'আ করতে পারে। যা আমরা দালীলিকভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে সালাফদের মানহাজার আলোকে কুরআন সুন্নাহর অনুসরণ করার তৌফিক দান করুন।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।☘

Post a Comment

0 Comments