মৃত্যুর পর নবজীবনের প্রাক্কালে মৃতের বিদায়ি সম্ভাষণ জানাজা। মহান আল্লাহ মানুষকে তিন অবস্থায় রাখেন— মাটির ওপরে, মাটির নিচে, মায়ের পেটে! আশ্চর্যের বিষয়, আমরা সবাই বেহেশতে যেতে চাই, কিন্তু মরতে চাই না। মহান আল্লাহর নির্দেশ—‘ওয়া লা তামুতুন্না ইল্লা ওয়া আন্তুম মুসলিমুন...।’ অর্থাৎ ‘প্রকৃত মুসলমান না হয়ে মরো না।’ কিন্তু মরণ আমাদের হাতে নয়।
•
মানুষের মৃত্যুর পর করণীয় হলো, দ্রুত জানাজা, দাফন-কাফন করা। জানাজা ‘ফরজ’। আঁতুড়ঘরেই এ নামাজের আজান-ইকামত হয়েছে! এখন শুধু চার তাকবিরের অপেক্ষা, নেই কোনো রুকু সিজদাও! ইদানীং জানাজাপূর্ব বক্তৃতা পর্ব বাহুল্যের সীমা ছাড়িয়েছে। সাধারণত মৃত ব্যক্তি ‘ভালো লোক’—এ বক্তব্যই ঘুরেফিরে উচ্চারিত হয়। এমনকি ক্ষেত্রভেদে তা হয় ‘রাজনৈতিক বক্তৃতার মুক্তমঞ্চ’।
•
বিশাল বক্তৃতা পর্বের জন্য জানাজার নির্ধারিত সময় বিলম্বিত হয়। পবিত্র কোরআনে আছে, ‘নিশ্চয়ই নামাজ মুমিনের জন্য সুনির্দিষ্ট সময়ের সঙ্গে ফরজ করা হয়েছে।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১০৩)
•
হাদিসে আছে, ‘তিন কাজে বিলম্ব করতে নেই। সেগুলোর অন্যতম হলো, ‘যখন জানাজার জন্য লাশ উপস্থিত করা হয়, তখন দেরি করতে নেই।’ জানাজার নির্ধারিত সময় বিলম্বিত হলে অনেকের সমস্যা হয়। অন্যদিকে একজনের শেষবিদায়কালেও আমরা কি ওয়াদা ভঙ্গকারী হব? প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘মুনাফিকের লক্ষণ, যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, যখন কোনো প্রতিশ্রুতি দেয় ভঙ্গ করে, যখন আমানত রাখা হয়, খেয়ানত করে।’ (বুখারি)
•
অথচ জানাজার বক্তৃতা পর্ব পরিবারের পক্ষে একজন ও ইমাম সাহেবের ‘মৃত্যুচিন্তামূলক’ বক্তব্যে সীমিত থাকলে হতো অনন্য নসিহতের দৃষ্টান্ত।
•
আমরা জানাজার কথা শুনলেই ছুটে যাই। ভাবা উচিত, নিজের জন্য যে ওয়াক্তিয়া নামাজ আদায় ফরজে আইন ছিল, তা কি আদায় হয়েছে? জানাজা তো ফরজে কিফায়া। অন্যদিকে বিভিন্ন ফতোয়ার কিতাবে আছে, ‘ব্যভিচারী, খুনি, আত্মহত্যাকারী, চোর-ডাকাতসহ সব নিন্দনীয় পাপাচারীর জানাজায় অংশগ্রহণ থেকে সমাজের গণ্যমান্য নেককার ও নেতৃস্থানীয় উলামায়ে কিরাম বিরত থাকবেন...।’ এমনকি যারা ঈমান-আকিদা বিরোধী কথা বলে, আল্লাহ, রাসুল, ইসলাম, কোরআনের দোষ খোঁজে তাদের জানাজায় অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকাও জরুরি। বিশেষ পটভূমিতে কোরআনে এসেছে, ‘তাদের মধ্যে যে মারা গিয়েছে, তুমি তার জানাজা পড়বে না এবং কবরের পাশেও দাঁড়াবে না।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৮৪, ৮৫)
•
প্রিয় নবী (সা.) জানাজার আগে জানতে চাইতেন, ‘এ ব্যক্তির কোনো ঋণ আছে কি?’ যদি বলা হতো, আছে। তিনি বলতেন, ‘ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য আছে কি?’ যদি বলা হতো, আছে। তিনি ওয়ারিশদের বলতেন, ‘ঋণ শোধ করে দাও...।’ (শরহে সুন্নাহ)
•
‘ওলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাজি’ গ্রন্থের একটি বর্ণনা জানাজাপূর্ব বক্তৃতার জন্য শিক্ষণীয়। উপমহাদেশের বিশিষ্ট সুফি সাধক কুতুবুল আফতাব খাজা সৈয়দ মুহাম্মদ কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকির [(রহ.) জন্ম ১১৭৩ হি. মৃত্যু ১২৩৫ হি.] সম্মান ও স্মরণে ভারতের দিল্লিতে ‘মুসলিম বিজয় স্মারক’ ‘কুতুব মিনার’ দাঁড়িয়ে আছে। এই বখতিয়ার কাকির জানাজায় সমবেতদের উদ্দেশে তাঁর অসিয়ত শোনানো হয়, ‘আমার জানাজা যে পড়াবে তার চার গুণ থাকতে হবে : যে ব্যক্তি জীবনে কোনো দিন তাকবিরে উলা (প্রথম তাকবির) ছাড়া নামাজ পড়েনি। যার জীবনে এক দিনও তাহাজ্জুদ কাজা হয়নি। যে ব্যক্তি তার চোখ দ্বারা পরনারী দেখে কখনো গোনাহের কল্পনা করেনি। যে ব্যক্তির জীবনে কোনো দিন আসরের সুন্নতও কাজা করেনি।
•
ঘোষণার পর নেমে আসে এক অধ্যাত্ম স্তব্ধতা। এমন যোগ্যতার কাউকে না পেয়ে বিনা জানাজায় লাশ দাফনের সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত। তখন এগিয়ে এলেন এক ব্যক্তি। বলেন, ‘আমি জানাজা পড়াব।’ তিনি প্রচলিত অর্থে আলেমও নন, আবার সাধারণ কেউ নন। তিনি এগিয়ে গিয়ে বখতিয়ার কাকির কপালে চুমু খেয়ে বলেন, ‘ওগো আল্লাহর বন্ধু। সারা জীবন নিজে আমল করে করে; তোমার আমল গোপন রেখে, আজকে আমার আমল প্রকাশ করে দিলে! আমি ভয় করি; আমার আমলগুলো প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় না জানি আমি ধ্বংস হয়ে যাই।’ তিনিই দিল্লির সুলতান শামসুদ্দিন আল-তামাস (রহ.)। এটাই জানাজা, এটাই জানাজাপূর্ব বক্তৃতার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
0 Comments